জনগণের ট্রেন
- গল্প লিখেছেনঃ সমর কুমার পাল
- তারিখঃ 2017-04-20
- ভিজিটঃ 2042
ঈদ। বাঙালির জীবনে এক অফুরন্ত আনন্দের উৎসব। ঈদের আনন্দ স্বজনের সাথে
ভাগাভাগি করে নিতে না পারলে গ্রাম বাংলার মানুষের যেন আত্মার শান্তি মিলে না। এমনই
একদিনে যখন ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের প্রবল স্রোতে বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, লঞ্চ
ঘাট লোকে লোকারণ্য তখন সম্মানিত জেলাপ্রশাসক, রাজশাহী মহোদয় ডেকে বললেন “ অভিযোগ
রয়েছে, রাজশাহী কামারুজ্জামান রেল স্টেশনে প্রশাসনের গণ্য মান্য ব্যক্তিদের নামে
ট্রেনের টিকেট রিজার্ভেশনের মাধ্যমে কালোবাজারি চলছে। জনসাধারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা
লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ট্রেনের টিকেট না পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি
থেকে জনগণকে মুক্তি দেওয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দেরি না করে তোমার টিম নিয়ে
মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করো”। ডিসি স্যারের আদেশ মোতাবেক তাৎক্ষণিকভাবে আইন শৃঙ্খলা
বাহিনিকে খবর দেওয়া হলো। সহকর্মী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জনাব ফয়সাল হক সহ ১৫
জন ফোর্স, বেঞ্চসহকারী মিলে আমরা ২০ জনের একটা টিম দুইটি গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলাম
রাজশাহী রেল স্টেশনের পথে। বের হওয়ার পূর্বে সহকর্মী ফয়সাল হক এবং সংগীয় ফোর্সের
সাথে পরিকল্পনা করে নিলাম যে, টিকেট কালোবাজারি ধরতে হলে আমাদেরকে ছদ্মবেশে অভিযান
পরিচালনা করতে হবে। পরিকল্পনা মাফিক স্টেশনে পৌছে টিকেট ক্রেতার ছদ্মবেশে টিকেট
কাউন্টারে গিয়ে ৪ টি রাজশাহী টু ঢাকার টিকেট ক্রয় করতে চাইলে কাউন্টার থেকে বলা
হলো যে কোন টিকেট নেই। কাউন্টারে টিকেট না পেয়ে শুরু হল কালোবাজারি টিকেট উদ্ধার
অভিযান। সহকর্মী ফয়সাল নিরাপদ দূরত্বে থেকে আমাকে অনুসরণ করছে, সাথে রয়েছে দুই জন
সিভিল পোশাক পরিহিত ফোর্স। আমি টিকেট ক্রয়ের জন্য বিক্রেতা খুঁজছি। টিকেট পেতে খুব
একটা বেগ পেতে হল না। রেলওয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই টিকেট প্রাপ্তিস্থান
দেখিয়ে দেওয়া হল। প্রাপ্তিস্থান ছিল রেলওয়ে তথ্য ও অনুসন্ধান কেন্দ্র; টিকেট
বিক্রেতা রেলওয়ে সিকিউরিটি ফোর্সের দুইজন কর্মী। ৪ টি টিকেট লাগবে বলতেই মূলদামের
চেয়ে দ্বিগুণ দামে টিকেট পাওয়া যাবে বলে জানানো হল। অর্থাৎ ৪ টি নন এসি চেয়ার
টিকেট ১৩০০/- টাকার পরিবর্তে ২৬০০/- টাকায় রফা হলো, এ সময় দূর থেকে অনুসরণ করা
সহকর্মী ফয়সাল তার সংগীয় ফোর্স সহ দুই জন কালোবাজারি টিকেট বিক্রেতাকে হাতে নাতে
ধরে ফেলেন। ততক্ষণে রেল স্টেশনে টিকেটের অপেক্ষায় থাকা জনগণ জেনে ফেলেছে যে,
কালোবাজারি টিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মোবাইল কোর্টকে
সহযোগিতা করলো। রেল সুপারকে খবর দেওয়া হলো তিনি আসলে তাকে সঙ্গে করে কাউন্টারে
গিয়ে প্রতিটি টিকেট বিক্রেতার পকেট সার্চ করে অধিকাংশের পকেটে বিক্রয়কৃত টিকেট
পাওয়া গেল। এখান থেকে আরও পাঁচজনকে আটক করা হলো। কিন্তু, দুঃখজনক হলো রেল
কর্তৃপক্ষ মোবাইল কোর্টকে সহযোগিতা করলেন না। তারা রেলওয়ে কর্মচারীদের
সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে তাদেরকে মোবাইল কোর্টের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে উদ্বুদ্ধ
করলেন এবং রাজশাহী থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিলেন। পাশাপাশি সকল প্রকার টিকেট
বিক্রয়ও বন্ধ করে দিলেন। হঠাৎ করেই
রাজশাহীর সাবেক মেয়র জনাব খায়রুজ্জামান লিটন ঘটনাস্থলে আসেন এবং মোবাইল
কোর্টের সাথে কথা বলে উদ্ভুত পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। ইতোমধ্যে রাজশাহীর
রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে এই খবর মাননীয় রেলমন্ত্রীর কানে পৌছে যায়। তিনি মেয়র
মহোদয়কে ফোন করেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে কথা বলতে চান। তখন আমি মাননীয় মন্ত্রীর
সাথে কথা বলে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করি। মন্ত্রী মহোদয় আমাকে তখন বলেন যে, এখন
ঈদের সময় সারাদেশে কোথাও রেলের সিডিউল বিপর্যয় হয়নি; রাজশাহীর সিডিউল বিপর্যয় হলে
জনগণ কষ্ট পাবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হবেন। আপনি যাদের আটক করেছেন তারা
প্রায় সবাই টিকেট বিক্রেতা; তাদেরকে নিয়ে গেলে টিকেট বিক্রিতে সমস্যা তৈরি হবে।
তিনি আমাকে এই বলে অনুরোধ করেন যে আটককৃত ব্যক্তিদেরকে আপনি মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিন
এবং তাদের একটি তালিকা করে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন; আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
নিব। মাননীয় মন্ত্রীর অনুরোধে এবং ঈদকালীন পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক মোবাইল কোর্ট
আটককৃতদের কাছ থেকে মুচলেকা গ্রহণ করে ছেড়ে দেয় এবং তাদের একটি তালিকা করে।
পরবর্তীতে এ সম্পর্কিত একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলে আমি
তদন্ত কমিটির নিকটে উল্লিখিত তালিকাটি হস্তান্তর করি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে তদন্ত
কমিটির প্রতিবেদন আজও পাওয়া যায়নি। আটককৃত রেলওয়ে কর্মীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও
গ্রহণ করা হয়নি। তবে, আশার কথা এটাই যে সেদিনের অভিযানের পর থেকে রাজশাহী রেল
স্টেশনের কালোবাজারি বন্ধ হয়েছে। জনসাধারণ সহজেই ট্রেনের টিকেট ক্রয় করতে পারছেন।
সেদিনের মোবাইল কোর্টের স্বার্থকতা এটাই।
পুনশ্চঃ
গত ১৪ এপ্রিল ছিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ। আমি রাজশাহী
থেকে ঢাকাতে যাওয়ার জন্য ১৫ তারিখের বিকেল ৪ টার ট্রেনের একটি টিকেট ক্রয়ের জন্য
স্টেশনে গেলাম। গিয়ে শুনলাম টিকেট সব
বিক্রয় হয়ে গেছে কারণ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে অনেক মানুষ রাজশাহীতে গিয়েছিল যারা
ঢাকাতে ফেরার টিকেট কেটে ফেলেছে। তাই কোন টিকেট অবশিষ্ট নাই। স্টেশন মাস্টারের
রুমে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে একটা টিকেটের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করলাম।
স্টেশন মাস্টার আমাকে চিনতে না পেরে আমাকে যে কথা বললেন তাতে আমার টিকেট না পাওয়ার
কষ্ট নিমেশেই উধাও হয়ে গেল। তিনি বললেন, স্যার আগে আমরা আপনাদের জন্য অনেক টিকেট
রিজার্ভ করে রাখতে পারতাম। কিন্তু, গত ঈদে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালানোর পরে
বিচারপতি আর এম,পি দের কোটা ব্যতীত কোন টিকেট রিজার্ভ করা হয় না। সব টিকেট
কাউন্টারেই বিক্রয় করে দেওয়া হয়। মনে মনে ভাবলাম, এটাই তো চেয়েছিলাম। জয়তু মোবাইল
কোর্ট। সমাজকে বদলে দেবার জন্য তোমার গুরুত্ব অপরিসীম।