ইস্টিশনের বাহারী পান, বৃষ্টি দিনে শর্ষে ইলিশ খান!
- গল্প লিখেছেনঃ জিনিয়া জিন্নাত
- তারিখঃ 2017-04-19
- ভিজিটঃ 2344
ইলিশ মাছ আর পদ্মা নদী যেন একসূত্রে গাঁথা। বিশেষ
করে শরীয়তপুরের সুরেশ্বরের ইলিশ স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়! আদিকাল থেকে ভোজন বিলাসী লোকদের কাছে সুরেশ্বরের পদ্মার ইলিশের চাহিদা রয়েছে। সারাবিশ্বেই এর খ্যাতি। ইলিশ মাছে রয়েছে উচ্চমাত্রায় আমিষ
যা মানব দেহ গঠনের জন্য প্রধান ভূমিকা রাখে। কিন্তু রূপালি এই ইলিশ সারা বছর ধরা পড়ে
না। এরজন্য মৌসুম ঠিক করা আছে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষায়। এ সময় সাগর থেকে
ঝাঁকেঝাঁকে ইলিশ নদীতে ছুটে আসে। বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনা নদীর বিভিন্ন এলাকাকে ইলিশের
অভয়ারণ্য মনে করা হয়। শরিয়তপুর জেলার পদ্মা নদীর নিম্নাংশে ২০ কিমি পর্যন্ত অভয়াশ্রম
ঘোষণা করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুমে সরকার কর্তৃক মা
ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ।
অক্টোবর ২০১৬ সালের এই নিষিদ্ধ সময়ে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ
মাহমুদুল হোসাইন খান মহোদয়ের নির্দেশে এবং তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে শরীয়তপুরের জাজিরা,
নড়িয়া, গোসাইরহাট ও ডামুড্যা উপজেলার ইলিশের অভয়ারণ্য খ্যাত পদ্মার প্রধান পয়েন্টগুলোতে চলছে মা ইলিশ ধরা রোধে সচেতনতামূলক
প্রচারাভিযান এবং একই সাথে চলছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক দিনরাত মোবাইল
কোর্ট পরিচালনা!
২৩/১০/২০১৬ তারিখ বেলা ১২:০০ ঘটিকার দিকে আমি অফিসের কাজে মহাব্যস্ত! এদিকে
জেলা প্রশাসক মহোদয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নিয়ে জরুরি মিটিং এ ব্যস্ত। এমন সময়
জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাকে ডেকে জানালেন, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার নিকট থেকে
প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বরের কাঁচিকাটা এলাকায় প্রায় ৩০/৪০ জন জেলে
পদ্মা নদীতে নেমেছে মা ইলিশ ধরতে সেখানে মোবাইল কোর্টে যেতে হবে এক্ষুণি! আমি
তৎক্ষণাৎ প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ, দুইজন পেশকার ও একজন অফিস সহায়ক নিয়ে যাবতীয়
প্রস্তুতি নিয়ে কাচিকাটার উদ্দ্যেশে রওনা দিই এবং ঐ এলাকায় দায়িত্বরত র্যাবের
একটি টিম সঙ্গে নিয়ে নিই। কাচিকাটার ঘটনাস্থলে ইতোপূর্বে পৌঁছে গেছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা
মৎস্য কর্মকর্তা ও তাঁর দল। উক্ত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশ ও র্যাবের সহযোগিতায় স্পীডবোট
ব্যবহার করে প্রায় ৫০০০ মিটার কারেন্ট জাল, সাড়ে ৩ মণ মা ইলিশসহ ২৮ জন জেলেকে
নদীতে ঘেরাও করে আটক করি। এরমধ্যে ১৯ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ২১ জন ছিল তরুণ জেলে এবং
বাকিরা সবাই বয়স্ক ও বৃদ্ধ। ওদের চোখেমুখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। ওদের শুকনো ক্ষুধার্ত অভাবক্লিষ্ট
দারিদ্র্যপীড়িত করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে খুব খারাপ লাগছিল। ওরা ধরা পরলে জেলে যাবে
সেটা জেনেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল পদ্মায় নেমেছে দুমুঠো ভাতের জন্য। মৎস্য
রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০ এর ৫ ধারার শাস্তি অনুযায়ী সর্বনিম্ন শাস্তি ১ বছর
কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দন্ড রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ওদের ১
বছর কারাদণ্ড দিলে ওদের পরিবারের অবস্থা শোচনীয় হবে অথবা ৫ হাজার টাকা জরিমানা
করলে ওরা জরিমানা পরিশোধ করে আবার মা ইলিশ ধরতে নামবে। পেটের তাড়নায় ওরা আইন ভাঙতে
বাধ্য হয়। ওরা যে মধ্যস্বত্বভোগী আড়তদারদের কাছে জিম্মি!
সার্বিক বিবেচনায় দেশের স্বার্থে, অসহায় জেলেদের জীবন বাঁচাতে ও মা ইলিশ
রক্ষার্থে জেলেদের মা ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময় পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া যুক্তিযুক্ত
মনে হল। তাই সরকার কর্তৃক জারিকৃত নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ না ধরার আদেশ অমান্য করায়
অর্থাৎ দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১৮৮ ধারা লঙ্ঘন করার দায়ে প্রত্যেককে মা ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ
সময় পর্যন্ত অর্থাৎ ২০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করি। জব্দকৃত কারেন্ট
জাল পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং জব্দকৃত মা ইলিশ স্থানীয় ৩টি এতীমখানায় সমপরিমাণে বিতরণ
করা হয়। এভাবেই মা ইলিশ রক্ষায় যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই দৃষ্টান্তমূলক
অভিযান পরবর্তী সময়ে শরীয়তপুর জেলায় মা ইলিশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এরকম সফল অভিযানের ফলেই শরীয়তপুরে পদ্মার মা ইলিশের অভয়ারণ্যে ফিরে আসে
স্বস্থি আর সম্ভব হয় মা ইলিশের সফল প্রজনন! তাই
আমরা বলতেই পারি – "
ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি,
শর্ষে ইলিশ মিষ্টি।
ইস্টিশনের বাহারী পান,
বৃষ্টি দিনে শর্ষে ইলিশ খান!"