একটি অভিযোগ ও পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান
- গল্প লিখেছেনঃ এ,এইচ, ইরফান উদ্দিন আহমেদ
- তারিখঃ 2017-04-18
- ভিজিটঃ 1896
“আমি একজন শিক্ষক। আমাদের চুলকাটি বাজারে কিছু অসাধু লোক ব্যবসার স্বার্থে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে অশ্লীল ভিডিও সরবরাহ করছে। আপনার কাছে আকুল আবেদন এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিবেন। সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান!”
জেলা প্রশাসক বাগেরহাট এর ফেসবুক আইডিতে ঠিক এরকমই একটি মেসেজ দিয়েছিলেন সদর উপজেলার বাসিন্দা জনাব মোক্তার হোসেন। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক। মেসেজটা একটু খেয়াল করে দেখলেই বুঝা যায় দুর্বৃত্তদের দাপটে কি পরিমাণ অসহায় তারা! কিভাবে জিম্মি হয়ে আছে শুভবুদ্ধির মানুষগুলো!
জেলা প্রশাসক তপন স্যার এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মমিনুর রশিদ স্যারের নির্দেশনায় সেদিন সাড়াশি অভিযান চালানো হয় সদর উপজেলার চুলকাটি বাজারে। চুলকাটি বাজারটি জেলার অন্যতম প্রসিদ্ধ এবং বৃহৎ বাজার। অলিতেগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দোকানগুলোকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন ছিলো। মোবাইল কোর্টের গাড়ি দেখলেই অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার কারণে বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েও আশানুরূপ সাফল্য পাওয়া যাচ্ছিলো না। তাই এবার দরকার ছিলো একটি নিছিদ্র নীলনকশার। বিশ্বস্ত একজন ড্রাইভার (যার বাড়ি চুলকাটি বাজারেই) এবং আমার পেশকারকে সাথে নিয়ে অভিযানের পরিকল্পনা আঁটলাম। সাথে পুলিশের একজন এস আই এর নেতৃত্বে ফোর্স ছিলো মোট ৬ জন। সবাইকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দুপুর ১২ টার দিকে রওনা করলাম। ইচ্ছে করেই ঠিক মাঝদুপুরে রওনা করলাম যেন লোকের ভিড় কিছুটা কম হয় এবং অভিযান পরিচালনা করতে সহজ হয়।
আমাদের গাড়ি দেখা মাত্রই দোকানপাট বন্ধ করে দিবে এটা প্রায় অনুমেয় ছিলো। তাই বাজার থেকে গাড়ি প্রায় ২০০ মিটার দূরে রেখে বাজারের পিছন দিয়ে যাওয়া খালের পাড় দিয়ে ঢুকলাম। আগে থেকেই ব্রিফিং করা ছিলো। তাই দোকানগুলো খুঁজে বের করতে সময় লাগলো না। প্রতিটা দোকানের সামনে একজন করে পুলিশ ফোর্স দাঁড় করিয়ে দিলাম যেন দোকান বন্ধ করতে না পারে। এরপরে নিজে শুরু করলাম দোকানে দোকানে তল্লাশি।
তল্লাশিকালে যে সকল তথ্য এবং পর্নো ভিডিও পেলাম তা রীতিমত আশঙ্কাজনক। প্রায় প্রতিটি মোবাইল/ফ্লেক্সিলোডের দোকানের কম্পিউটারেই মজুদ করা আছে বিপুল পরিমাণ অশ্লীল ভিডিও এবং ছবি। অনেকেই অতিরিক্ত ১/২ টেরাবাইটের হার্ডডিস্ক বোঝাই করে রেখেছে নীল ছবি দিয়ে। জিজ্ঞাসাকালে প্রত্যেকেই স্বীকার করেন যে, মাত্র ২০-৩০ টাকার বিনিময়ে যেকোনো বয়সের এবং পেশার মানুষের কাছেই তারা এই ভিডিও এবং ছবি সরবরাহ করেন। খদ্দের মূলত কারা জানতে চাইলে এদের মধ্যে ৩ জন স্বীকার করেন যে, ক্লাস সেভেন থেকে শুরু করে মাঝবয়সী সবাই তাদের দোকানে নিয়মিত আসে। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে মোবাইলে লোড করে নিয়ে যায় এসব ভিডিও!
আশ্চর্য হয়ে দেখলাম এদের বেশিরভাগের কম্পিউটারেই বাচ্চা বয়সী (আনুমানিক ৯-১২ বছর বয়সী) মেয়েদের অশ্লীল ভিডিও আলাদা ফোল্ডার করে রাখা আছে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এসকল ভিডিওর চাহিদা নাকি বেশি! তাই নতুন নতুন ফোল্ডার করে আনা হয়! বুঝতে বাকি রইলো না ৫ বছরের বাচ্চা মেয়েকে রেপ করা নরপশুগুলোই এদের মূল খদ্দের। এরা ব্যবসার খাতিরে একটু একটু করে খেয়ে নিচ্ছে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে। ছড়িয়ে দিচ্ছে অশ্লীলতা একদম গ্রাম পর্যায় থেকে!
মোট ৭ টি দোকানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এরমধ্যে ৫ টি দোকানের কম্পিউটারে বিপুল পরিমাণ পর্নো ছবি ও ভিডিও পাওয়ায় সেসকল দোকান মালিকদের প্রত্যেককে ৫,০০০/- (পাঁচ হাজার) টাকা করে জরিমানা করা হয়। সাথে জব্দ করা হয় ৪ টি কম্পিউটার এবং একটি হার্ডডিস্ক। ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় এবং বাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর লোক ঘটনাস্থলে এসে জড়ো হয়। তাদের পুরো বিষয়টি ও চলমান অভিযান সম্পর্কে ব্রিফ করা হলে স্থানীয় জনসাধারণ মোবাইল কোর্টের ভূমিকার ব্যাপক প্রশংসা করেন এবং অঙ্গীকার করেন যে এখন থেকে তারা আরও সচেতন হবেন। নিজ থেকেই পদক্ষেপ নিবেন এই অশ্লীল ব্যবসায়ীদের মোকাবেলা করার!
দিনশেষে সেই শিক্ষকের সাথে কথা বলা সম্ভব হয় নি। যদি সম্ভব হতো তবে একটা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতাম। ধন্যবাদ জানাতাম একটা ভাল কাজের সাথে নিজেকে জড়ানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্য। আপনার মত সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে সমাজের ভাবমূর্তি রক্ষায় এগিয়ে আসেন তাহলে অন্যায় করার আগে মানুষ অবশ্যই আরেকবার চিন্তা করবে! আর এভাবেই আমরা গড়ে তুলতে পারবো একটি সুস্থ ও সুন্দর সোনার বাংলা।