মাদক ছেড়ে জীবনের পথে

Client Logo
  • গল্প লিখেছেনঃ  দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা
  • তারিখঃ 2017-04-18
  • ভিজিটঃ 1722
 
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনে কর্মরত সকল নবীন পুরুষ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের চাকরির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পালাক্রমে এক সপ্তাহের জন্য রামসার সাইট হিসেবে সংরক্ষিত টাঙ্গুয়ার হাওরে ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব পালন। সেবার ২৩.০৭.২০১৬ খ্রি. হতে ২৯.০৭.২০১৬ খ্রি. পর্যন্ত এক সপ্তাহের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরের ডিউটি আমার উপর অর্পিত হলে ২২.০৭.২০১৬ খ্রি. শুক্রবার বিকেলে পূর্ববর্তী সপ্তাহে দায়িত্ব পালনকারী সহকর্মীর কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণপূর্বক ট্যাকেরঘাটে বিদ্যমান টাঙ্গুয়ার হাওরে ডিউটিরত ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় কাম বাসভবনে পৌঁছে যাই। টাঙ্গুয়ার হাওরের পাড়ে অবস্থিত ট্যাকেরঘাটসহ স্থল ভাগের পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় এমন প্রায় সম্পূর্ণ অংশ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত লাগোয়া বলে যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটামুটি দূর্গম এবং যোগাযোগের জন্য মোটরসাইকেলই একমাত্র ভরসা। সেদিন ২৬.০৭.২০১৭ খ্রি. তারিখ রোজ মঙ্গলবার টাঙ্গুয়ার হাওরে নিয়মিত টহল ডিউটির পর বিকেলের দিকে ট্যাকেরঘাট সংলগ্ন বড়ছড়া বাজারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে এই মর্মে সংবাদপ্রাপ্ত হই যে, এর পার্শ্ববর্তী চানপুর বাজারের নিকটবর্তী রজনীলাইন গ্রামে এক লোক মদ্যপান করে মাতলামি করছেন এবং তার অনুরূপ কাজে বাধা প্রদান করায় একজনকে দা দ্বারা কুপিয়ে জখম করেছেন এবং তাকে নিবৃত্তও করা যাচ্ছে না। ঘটনাস্থলটি  দূরবর্তী না হওয়ায় মোবাইলে ঐ ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বারকে যথাস্থানে থাকার অনুরোধ জানিয়ে আমি ট্যাকেরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বরত এস আই তপনবাবুসহ প্রয়োজনীয় ফোর্স সহকারে দ্রুত ঘটনাস্থলে গমন করি। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখি প্রচুর লোক জটলা হয়ে বিনে পয়সায় মাতালের তামাশা দেখছে অথবা মাতালের ভবিষ্যত পরিণতির তামাশা দেখার অপেক্ষায়।আর লোকসমাগমের অন্যপাশে একটু দূরে ঘটনার নায়ক দা হাতে টালমাটাল অবস্থায় হুমকি-ধামকি ও খিস্তিখেউর ছুঁড়ে চলেছেন। ফোর্সসমেত আমাকে দেখে মেম্বার সাহেব আমার কাছে এসে করণীয় জিজ্ঞেস করলে জটলা সৃষ্টিকারী অপ্রয়োজনীয় জনসমাগম দূর করার এবং একটু বসার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করলে তিনি আমার পরিচয় প্রদানপূর্বক সেখানে অবস্থানকারী লোকজনকে যার যার কাজে চলে যাবার নির্দেশ প্রদান করেন এবং আমাকে বসার ব্যবস্থা করে দেন।কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকের জটলা ফাঁকা হয়ে যায়। অতঃপর মাতাল লোকটিকে আমার সমীপে হাজির করার নির্দেশ প্রদান করলে তপনবাবু কৌশলে তাকে ধরে এনে আমার সামনে হাজির করেন।লোকটির মুখ থেকে বিশ্রী ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলে সে নেশায় আড়ষ্ট জীভে উচ্চারিত ঘোরগ্রস্থ বাক্যে অকপটে তার নাম, পিতার নাম, ঠিকানা বলেন এবং স্বীকার করেন যে, সে মনের দুঃখে চোলাই মদ পান করেছেন। যদিও তার দাবি সে এই প্রথমবার মদ্যপান করেছে; কিন্তু মেম্বারসহ উপস্থিত কিছু গণ্যমান্য এলাকাবাসীর দাবি প্রায়সময় সে মদ্যপান করে মাতলামি করে এবং তার অনুরূপ কাজে বাধা প্রদান করলে বেপরোয়া হয়ে উঠে।অবশেষে, মোবাইল কোর্টের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসুরণ করে তাকে (রাকিব)মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ এর ২২(ঘ) ধারা অনুযায়ী প্রথমবারের মতো ১৫ (পনেরো) দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করে সুনামগঞ্জ জেলা কারাগারে প্রেরণ করি। উক্ত ঘটনার প্রায় মাসখানেক পর সেপ্টেম্বরের শেষে অথবা অক্টোবরের প্রথমদিকে পুনরায় টাঙ্গুয়ার হাওরে ডিউটি অর্পিত হলে সপ্তাহান্তে ডিউটি শেষে শুক্রবার সকালে সুনামগঞ্জ ফিরছিলাম। রজনী লাইন এলাকায় পৌঁছলে দেখি রাত্রে সংঘটিত ঝড়-বৃষ্টির দরুন রাস্তার মাঝখানে একটি মোটামুটি সাইজের গাছ পড়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় হাওরে দায়িত্বরত আমাদের (ম্যাজিস্ট্রেটদের) মোটরসাইকেল ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে গাছটি সরানোর চেষ্টা করেও সফল হচ্ছিল না দেখে আমিও হাত লাগাবো বলে এগিয়ে যেতেই দেখি একজন লোক দ্রুত ড্রাইভার মনিরকে সাহায্য করতে এসেছে এবং তারা দুজনে মিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছটি রাস্তার একপাশে সরাতে সক্ষম হয়।  লোকটির প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে যাব এমন সময় সে আমার নিকট উপস্থিত হয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, স্যার আমাকে চিনেছেন? আমি স্মৃতি হাতড়াতে থাকি। আমাকে ইতস্তত দেখে মনির বলে উঠেন, স্যার ঐ যে, মাতলামির দায়ে আপনি একজনকে পনেরো দিনের কারাদন্ড দিয়েছিলেন এই জায়গায়। উনিই সেই ব্যক্তি, যাকে আপনি জেলে পাঠিয়েছিলেন। প্রকৃত অর্থে, ঘটনাটি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।মনিরের সহায়তায় বিষয়টি স্মরণে এলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ভুলে ম্যাজিস্ট্রেট সত্তা জাগিয়ে জিজ্ঞেস করি, এখনো কি মদ খান? কী করেন এখন? প্রত্যুত্তরে তিনি যা বললেন তা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। নিস্পৃহ অথচ দৃঢ় কন্ঠে তিনি বললেন, না স্যার, আমি এখন আর মদ খাই না, ভবিষ্যতেও খাব না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। একটি ছোট ডিস্পেনসারির দিকে তর্জনি নির্দেশ করে বললেন, ঐটি আমার, মদের নেশায় ব্যবসা লাটে উঠে গিয়েছিল; জেল থেকে আসার পর চিন্তা করলাম, আর নিজেকে ধ্বংস করা নয়, আবার নতুন করে শুরু করেছি সবকিছু। দোয়া করবেন স্যার। আমার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটে না; মুখে বলি, শুনে খুশি হলাম রাকিব; অবশ্যই দোয়া থাকবে। আর মনে মনে বলি, সাবাস, রাকিব; জীবনের পথে ফিরে আসায় আপনাকে স্যালুট।  

 প্রিন্ট