অনুশোচনা যখন শাস্তিকে ছাড়িয়ে যায়...

Client Logo
  • গল্প লিখেছেনঃ  ফারজানা আলম
  • তারিখঃ 2017-04-18
  • ভিজিটঃ 1966
 
অক্টোবর মাস। মা ইলিশ রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেটগণ যখন রাত্রি দিনের হিসেব ভুলে জলে স্থলে নিরন্তর অভিযান চালাচ্ছে, তখন চাঁদপুরের সফরমালী ইউনিয়নের ছোট্ট নির্জন খালের উপর এক ডিঙ্গি নৌকায় বসে সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ মনে মনে রুপালি ইলিশের স্বপ্ন দেখছিল। আপন মনে আব্দুল কাশেম তার নাতিকে নিয়ে মৃতপ্রায় একটি খালের উপর নৌকায় বসে অতি আদরের জিনিসখানি ভাঁজ করে রাখছিল। গুছিয়ে রাখছিল পরম যত্নে তার প্রিয় জালখানি (কারেন্ট জাল), অভিযানের (মাছ ধরা) পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে। রাতে পদ্মায় নামতে হবে, আনতে হবে ঘরে রুপালি ইলিশ। আমার সেদিনের দায়িত্ব ছিল স্থলে। পথে ঘাটে, হা্টে, বাজা্রে কোথাও মা ইলিশের বেচাকেনা হচ্ছে কিনা, কেউ পরিবহন করছে কিনা, তাই দেখতে হবে। পাহারা দিতে হবে সেই সকল পথগুলো যে পথগুলো দিয়ে অবৈধ মাছ পাচার হয়। যথারীতি সঙ্গীয় ফোর্সসহ অলি গলি চষে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের মাইক্রোবাসটি সেই খালের পাশের রাস্তায় গিয়ে ব্রেক কষলো। গাড়ী থামার সাথে সাথে মৎস্য অফিসারসহ ফোর্সের সবাই তুরুকের গতিতে নেমে গেল তাদের ধরতে। আমি শুধু এক ঝলক বৃদ্ধের চোখটা দেখলাম। মুহূর্তে তার চেহারায় সর্বহারার ছাপ দেখতে পেলাম। কি করুন সেই চাহনি! তার কষ্ট যেন মুহূর্তে আমাকে ছুঁয়ে গেল। ততক্ষণে সে খালে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার নাতিকে নিয়ে। খালের উপর একটা মাত্র বাঁশ দিয়ে সাকু তৈরি করা। বুট জুতা দিয়ে পার হওয়া খুবই কষ্টকর। তবু পুলিশের কনস্টেবলগণ তা পার হয়ে সেই লোকটিকে ধরতে সক্ষম হলেন এবং আমার কাছে হাজির করলেন। নাতিটিকে ধরা গেলনা। ও পালিয়ে গেল। অপরাধতো সে করেছে, অপরাধীও ধৃত। এবার আমার পালা। সাজাতো দিতেই হবে। মৎস্য আইন বড় কড়া। মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষন আইন, ১৯৫০ এর ৪ক (১) বিধান অনুযায়ী কারেন্ট জাল মজুদ, বহন, পরিবহন করা, অধিকারী হওয়া কিংবা ব্যবহার করা যাবে না। করলে, ৫(২) অনুযায়ী অনূন্য তিন বছরের জেল এবং সাথে অর্থদণ্ডও প্রদান করিতে হবে যা এই আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত। অর্থাৎ নিয়মিত মামলা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আদেশ দিতে হবে। এসব আকাশ পাতাল যখন ভাবছি তখন হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম, দেখলাম সেই বৃদ্ধ আমার পা জড়ায়ে হাউ মাউ করে কাঁদছে। আমি দ্রুত সরে এসে উনাকে উঠতে বললাম এবং কাঁদতে বারন করলাম। ততক্ষণে সাড়া গ্রামের লোক জড়ো হয়ে গেছে। সতর্ক দৃষ্টিতে পরিস্থিতি আঁচ করে নিলাম। উপস্থিত জনতার মন পরখ করে নিয়ে বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি অনুকুলেই আছে। অসংখ্য দৃষ্টি আমার উপর। কি করি আমি, তাই দেখবে। এবারে আমি ভাল করে করণীয় ভেবে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম কেন তিনি এই কাজ করেছে, আইনত নিষেধ থাকা সত্বেও। লোকটির কথায় এবং তার সমর্থনে আসা শতাধিক লোকের ভাষ্যমতে বোঝা গেল লোকটি নিতান্তই সৎ, গরীব ও সরল প্রকৃতির লোক। তিনি পুর্বে ঐ ইউনিয়েনের মেম্বারও ছিলেন। ঘরে তার অসুস্থ স্ত্রী এবং সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তার ছেলে মারা গিয়েছে। পরিবারে সে, তার শয্যাশায়ী স্ত্রী, তার পুত্রবধু এবং পাঁচ বছরের সেই নাতী। সে শুধু হাউ মাউ করে চিৎকার করছে আর বলছে যে, সে না বুঝে করে ফেলেছে, আর কোনদিন করবেনা, এবং বারংবার ক্ষমা চাইছে। উপস্থিত শতাধিক লোকও তাকে ক্ষমা করার মিনতি করতে লাগলো আর বলতে লাগলো তার পরিবারটি ধ্বংস হয়ে যাবে তার কিছু হলে। ঐ এলাকার মেম্বার এসে উপস্থিত হলেন। এবার আমি আমার বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। তাদেরকে তাদের কৃত অপরাধের প্রভাব এবং দেশ ও জাতির কি পরিমান ক্ষতি হচ্ছে এই কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মা ইলিশ ধরাতে ফলে এবং প্রকারান্তরে যে তারা (জেলে কমিউনিটি) নিজেরাই বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, এসব বোঝালাম। এই সময়ে কেন মা ইলিশ ধরা বন্ধ করা হয়েছে, এতে কিভাবে আমরা উপকৃত হব, সবকিছু বললাম। এতগুলো মানুষ একটা কথা না বলে আমার কথা শুনলেন। এবার আমি বললাম আপনারা যে উনাকে ছেড়ে দিতে বলছেন, এটা আমি কিভাবে করবো আপনারাই বলেন। সমস্ত গ্রামের মানুষের পক্ষে মেম্বার আমাকে বলল, এ কথা সত্য যে আমাদেরকে এই সময়ে মা ইলিশ ধরতে বারন করা হয়েছে এবং কারেন্ট জাল ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে, তবু আমরা করি, কারন আমরা জেলে এবং গরীব। তবে আজ আমরা আপনাকে কথা দিলাম আমরা এই মৌসুমে নিষিদ্ধ সময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত নদীতে নামবো না। আপনাদের এই এলাকা অন্ততপক্ষে আর পাহারা দিতে হবে না শুধু ওকে ছেড়ে দিন। আমি সার্বিক বিবেচনায় অপরাধ সংগঠিত এবং উদ্ঘাটিত হওয়ার পরও অপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম। তার জাল পুড়িয়ে দেওয়া হলো। বিজ্ঞ ম্যজিস্ট্রেটগণ হয়তো আমার উপর দায়িত্ব অবহেলার আরোপ আনতে পারেন কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেদিন আমি তাঁকে ছেড়ে দিয়েই বেশী স্বস্তি পেয়েছিলাম। সেটিই আমার ন্যায় বিচার মনে হয়েছে সেই পরিস্থিতিতে। মনে হয়েছে একটি অপরাধীকে ছেড়ে দিলে যদি আরো অনেকগুলো সম্ভাব্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হয়, যদি আরো অনেকগুলো অপরাধী অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে, তবে সেটা কি বেশী ভালো নয়? সেটিই কি আমাদের কাম্য নয়? বাস্তবিক কোনটা ন্যায় বিচার তার ভার আপনাদের উপর।

 প্রিন্ট