ভেজাল দুধের খাটি গল্প
- গল্প লিখেছেনঃ মোঃ ফোরকান এলাহি অনুপম
- তারিখঃ 2017-04-18
- ভিজিটঃ 2745
দিনটা শনিবার ছিল বলে অফিসে যাবার ব্যস্ততা নেই। বাসাতেই
ছিলাম দুপুরের পর থেকে, শুধু সকালে প্রটোকলের কিছু কাজ ছিল। হঠাৎ অতিরিক্ত জেলা
ম্যাজিস্ট্রেট মমিনুর রশীদ স্যারের ফোন আসলো। স্যার জানালেন যে, ডিবি পুলিশের গোপন
তথ্যের ভিত্তিতে মোবাইল কোর্ট করতে হবে। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে নিলাম আর তথ্যের সাথে
সঙ্গতিপূর্ণ ভেবে বিএসটিআই এর ইন্সপেক্টরকে সাথে নিয়ে রওনা দিলাম চট্টগ্রাম
মেট্রোপলিটনাধীন মাঝিরঘাটের পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকার উদ্দেশ্যে। ইতোমধ্যেই মমিনুর
রশীদ স্যার মিডিয়াকে সংবাদ দিয়ে রেখেছেন বিধায় পথিমধ্যেই মিডিয়া থেকে ফোন আসতে
শুরু করলো। আনুমানিক বিকাল ৪.০০ টায় পূর্ব মাদারবাড়িতে পৌছেই ছিরু মিয়ার বাড়ি
সংলগ্ন নূর ডেইরি এণ্ড ফুড প্রসেসিং ফ্যাক্টরির গোডাউনে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা
করি। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গুড়া দুধের বস্তাতে গোডাউন ভর্তি হয়েছিল। বিভিন্ন
ব্রান্ডের গুড়া দুধের বস্তা দেখতে পেলাম। খাকি রঙের স্তুপীকৃত কিছু বস্তা সরাতেই
নীচ থেকে সাদা রঙের বস্তা বের হয়ে আসলো। বস্তা পরীক্ষা করে দেখলাম বস্তাতে
প্রিন্টেট লোগো থাকলেও উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের লেখাটি সীল দিয়ে লাগানো হয়েছে
কিছুটা বাঁকাভাবে। আরও কিছু বস্তা পরীক্ষা করে একই রকম দেখতে পেলাম। আশেপাশে
অন্যান্য ব্রান্ডের বস্তা পরীক্ষা করে দেখলাম যে যে বস্তাতে মেয়াদকাল স্পষ্টভাবে
লিখা আছে সে রকম কিছু বস্তাতে ঐ সীল লাগানো হয়েছে, বুঝলাম যে সীল টেস্ট করার জন্য
কেউ এই কাজ করেছে। সাদা রঙের কয়েক হাজার বস্তা গুড়া দুধের প্যাকেটে কোন মেয়াদকাল
উল্লেখ নেই। এই অশুভ চক্রটি বিদেশ থেকে এভাবে গুড়া দুধ আমদানি করে নিজেদের ইচ্ছামত
উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের সীল লাগিয়ে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করছে। সম্পূর্ণ
অননুমোদিতভাবে এই বিশাল চালানটি দেশে ঢুকে পড়েছে। নূর ডেইরি ফুডসের মালিক নাজিম
উদ্দিন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলো না। গোডাউনের কেয়ারটেকারের মাধ্যমে কৌশলে তাকে
ঘটনাস্থলে উপস্থিত করানো হলো। মোবাইল কোর্ট চলছে দেখে তাকে কিছুটা বিচলিত মনে হলো।
প্রথমে তো সে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বসলো। বস্তাগুলো পরীক্ষা করে সুনির্দিষ্টভাবে
তাকে প্রশ্ন করার এক পর্যায়ে সে দোষ দ্বীকার করে। ইতোমধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
শামসুল আরেফিন স্যারকে ফোন করে বিস্তারিতভাবে সবকিছু জানাই। বেশ কয়েক ঘন্টা সময়
অতিক্রান্ত হয়েছে বিধায় মিডিয়া কর্মীরা মামলার চূড়ান্ত রায় জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
আমি আসামী নাজিম উদ্দিনকে দেড় লক্ষ(১৫০০০০) টাকা অর্থদণ্ড ও তিন(০৩) মাসের
কারাদণ্ডের আদেশ দেই ও গুড়া দুধের প্যাকেটগুলো জব্দ করি। এরপরেই শুরু হয় সমস্যা,
সাড়ে চার হাজার বস্তা গুড়া দুধ জব্দ করে কোথায় রাখবো? অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
মমিনুর রশীদ স্যারের কাছ থেকে ফোনে নির্দেশনা নিয়ে জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে
নিয়ে আসার ব্যাপারে মনস্থির করি। কিন্তু স্থানীয় খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন
ছল-চাতুরি শুরু করে। সব ট্রাক-পিকআপের ড্রাইভার-হেলপারদের ঐ এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে
ফেলে। এতগুলো প্যাকেট কিভাবে সরাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ততক্ষণে গভীর রাত হয়ে গেছে।
আশে-পাশে লোকজনও নেই তেমন, শুধু চলছে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের আনাগোনা আর
চাতুর্যপূর্ণ বিভিন্ন কৌশল। স্থানীয় রাজনৈতিক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে
আমার মোবাইল ফোনে কল আসতে শুরু করলো। এরই মধ্যে জেলাপ্রশাসক সামসুল আরেফিন স্যার
ফোন দিয়ে অভয় দিয়ে বললেন যা করছি তা দৃঢ়চিত্তে চালিয়ে যেতে, যা সঠিক ও ন্যায্য মনে
করবো তাই করতে নির্দেশনা দিলেন, মনের জোর বেড়ে গেলো। রাস্তা থেকে দূরগামী একটা ট্রাক
থামালাম। ঐ ট্রাকের মাধ্যমেই গূড়া দুধ গোডাউন থেকে বের করবো ভাবলাম কিন্তু
পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম সাড়ে চার হাজার বস্তা গুড়া দুধ একটা ট্রাক দিয়ে সরাতে অনেক
দীর্ঘ সময় লাগবে যা রাত দশটার সময় অনেকাংশেই বাস্তবসম্মত হবে না। কনজ্যুমারস
এসোসিয়েশনের একজন সদস্যকে ফোন করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত করালাম। তারপর পাঁচটি গুড়া
দুধের বস্তা আলাদা করে প্রতিটিতে বিএসটিআই
এর পরিদর্শক, ক্যাবের প্রতিনিধি, উপস্থিত সাক্ষী, গোডাউনের তত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষর
নিলাম এবং আলামত হিসেবে তিনটি বস্তা জেলা ট্রেজারিতে পাঠিয়ে দিলাম। দুইটি বস্তা
লালসালু কাপড়ে মুড়িয়ে উপস্থিত সকলের স্বাক্ষর নিয়ে বিএসটিআই এর পরীক্ষাগারে
পরীক্ষার মাধ্যমে রিপোর্ট প্রদানের উদ্দেশ্যে পাঠাবার আদেশ দিলাম। বাকী গুড়া দুধের
বস্তাগুলো জব্দ করে গোডাউনটি সীলগালা করে দিলাম।
পরবর্তীতে আসামীপক্ষ বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার
করার চেষ্টা করেছে এবং প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগের অপপ্রয়াস চালিয়েছে।
আইনজীবী সমিতির শীর্ষস্থায়ী আইনজীবীদের মাধ্যমে আপীল করে মামলা পরিচালনা করে
কিন্তু দায়রা জজ আদালত পর্যন্ত আমার মোবাইল কোর্টের আদেশ বলবৎ থাকে। এই ঘটনাটা
আমার কর্মজীবনে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। উপযুক্ত অভিভাবকের অধীনে থেকে
যথাযথভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে যে সমাজের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের
শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব তারই প্রমাণ পেয়েছিলাম সে দিন।
মোবাইল কোর্ট চলুক। অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটুক আইনের
সুনিপুণ প্রতিঘাতে।