A Paradox of Justice or Equity! (বিচার না ইনসাফ কোনটা করব?)


- গল্প লিখেছেনঃ মোঃ শরীফ উদ্দিন
- তারিখঃ 2017-04-17
- ভিজিটঃ 1558
‘পকেট জেলা’ নেত্রকোণা বেশ শান্ত, সৌম্য। সহকারী
কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেই প্রথম পদায়ন হয় এ কৃষিনির্ভর এ
জেলায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বলিয়ান নেত্রকোণায় মোটের উপর সবকিছুই যেন ঠিকঠাক চলছিল
কিন্তু চাঁদের কলংকের মত সমস্যা হচ্ছিল মাদক আর কিছু মানুষের অসামাজিক কর্মকান্ড।
জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায়, জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ নিয়ে সদস্যরা সবাই আলোচনা
করলেন যে কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। তারপর সিদ্ধান্ত হলো যে বহুমুখী একশন
নেয়ার যার মধ্যে ছিল ভ্রাম্যমাণ আদালত জোরদার করার।
আমাদের কাছে খবর ছিল যে শহরের কয়েকটি হোটেলে মাদক
ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলছে। নেত্রকোণা সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার একদিন ফোন করে জানালেন যে তাদের কাছে তথ্য আছে
যে একটি হোটেলে অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলছে। জানার পর, আমরা প্রস্তুতি নেই ভ্রাম্যমাণ
আদালত পরিচালনার। পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্যসহ, সহকারী পুলিশ সুপার, সদর সার্কেল, ইন্সপেক্টর,
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং আমি নির্দিষ্ট দিনে অপারেশনে যাই।
নির্দিষ্ট হোটেলে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নেন এবং সাথে
সাথে আমরা হোটেলে প্রবেশ করি। সাথে সাথে হোটেলের বিভিন্ন কক্ষ থেকে ৫০গ্রাম
গাঁজাসহ দুই ব্যক্তি এবং অসামাজিক কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে মিলিত তিন বিশ্ববিদ্যালয়
পড়ুয়া ছাত্র ও তাদের সাথে স্থানীয় কলেজ পড়ুয়া তিন ছাত্রী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক
শিক্ষিকা সাথে এক স্থানীয় ব্যবসায়ীকে আটক করি। ইতিমধ্যে অনেক টিভি ও প্রিন্ট
মিডিয়ার সাংবাদিক হাজির হয়েছেন।
গাঁজা সাথে রাখা এবং সেবন করে মাতলামির জন্য মাদক
বিভাগের ইন্সপেক্টর আটক দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন দেন। পরে ঐ ব্যক্তিগণ
তাদের অপরাধ স্বীকার করলে তাদেরকে ছয়মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। গাঁজা
আমাদের সকলের উপস্থিতিতে ধবংস করা হয়।
সবই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু সমস্যা হলো, ছাত্র ও
শিক্ষক নিয়ে।
শিক্ষক প্রসংগে আসি। মহিলা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যার দুটি বাচ্চা
আছে। জিজ্ঞেস করলাম এ কাজে কেন এসেছেন। তিনি অস্বীকার করলেন। পরে আরো প্রশ্ন করতে
থাকলে এক পর্যায়ে স্বীকার করলেন। তিনি বললেন, যে মায়ের অসুস্থতার চিকিৎসার টাকা
জোগাড়ে আজই প্রথম এ পথে এসেছেন। তিনি কিছুক্ষণ আগে মাত্র এসেছেন। আমি বললাম যে উনাকে যদি শাস্তি দেয়া হয় উনার যে
চাকরি চলে যেতে পারে উনি তা জানেন কিনা। শুনে উনি কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন।
পরিবেশ ভারী হয়ে আসল। সার্বিক বিবেচনায় নিজের ডিস্ক্রিসন এপ্লাই করি। মহিলার বাধ্য
হয়ে আসে, দুইটা বাচ্চার ভবিষ্যতসহ সার্বিক বিবেচনায় মহিলাকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে
দিলাম। একজন শিক্ষক এ কাজে নামছেন এটা গ্রামভিত্তিক একটা সমাজে জানাজানি হলে এর
নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এ বিবেচনাও ছিল।
এবার আসি তিনজন কলেজ ছাত্রী ও তাদের সাথে থাকা
তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের প্রসংগে। আটক তিন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রেরই বাড়ি
নেত্রকোণা। ছাত্রীরা স্থানীয় বিভিন্ন কলেজের ছাত্রী। ছাত্রদের দুইজন ২য় বর্ষে আর
একজন তৃতীয় বর্ষে পড়ে। ছাত্রীরা তিনজন এইচ এস সি ১ম বর্ষের। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল তারা একে অপরকে ভালবাসে। দীর্ঘক্ষণ
জিজ্ঞসাবাদের পর বুঝলাম যে আসলে এরা আবেগের বশবর্তী হয়ে এ কাজ করেছে। এদিকে
মেয়েগুলো নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে কান্নাকাটি করছে। সাংবাদিকরা বিভিন্ন ধরণের
প্রশ্ন শুরু করে দিয়েছেন। এ অবস্থায় মনে মনে চিন্তা করলাম যে আজ বিচারের আগে ইনসাফ
করব। এ অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের আরেকটি সুযোগ দিতে।
খবর করলাম সবার অভিভাবককে। অভিভাবকদের খবর নিতে
গিয়ে আমার নিজেরই চোখ টলমল করার অবস্থা। কারো বাবা জমি বিক্রি করে পড়াচ্ছেন, কারো
বাবা মসজিদের মুয়াজ্জিন, কারো বাবা দিনে আনে দিনে খায়! এখন এরকম অভিভাবককে কিভাবে
বলি তাদের ছেলেদের এহেন কর্মকাণ্ডের কথা! ততক্ষণে ছেলেগুলো ও বুঝে গেছে যে তারা যা
করেছে তা গর্হিত এবং তাদের গরীব বাবা-মায়ের সাথে প্রতারণার মতো। সবাই কান্নাকাটি
করছে। যাহোক, ফোন দিলাম তাদের
নিকটাত্মীয়দের আসার জন্য। মেয়েদের অভিভাবকদের ও ফোন করে আসতে বললাম।
অভিবাবকরা আসার আগে ভাবলাম সাংবাদিকদের সাথে একটু
কথা বলি। সবাইকে বললাম আমি কিছু বলতে চাই। বললাম আপনারা সবাই তথ্য জানতে চান, ঘটনা জানতে
চান, টিভিতে দিতে চান কিন্তু আমি চাই এটির কোনটাই যেন না হয়! সবাই বেশ ধাক্কা
খেলেন। সবাইকে বললাম, দেখেন আপনাদের সামনে যে ছেলে-মেয়েগুলো আছে ওরা বয়সে অনেক ছোট
এবং সবাই ছাত্র ছাত্রী। এরা সকলেই আপনাদের এলাকার সন্তান। কেউই আমার আত্মীয় না।
কাউকে আমি চিনিও না। তবে তাদের সামনে অফুরন্ত ভবিষ্যত । এরা বেশিরভাগই গরীবের
সন্তান। এরা কেউই সিরিয়াল অপরাধী না। আবেগের কারণে একটা ভুল/অপরাধ করেছে। এখন যদি
আপনারা টিভিতে ফলাও করে নাম ঠিকানাসহ
প্রচার করেন তাহলে ওদের পরিবারের সকল আশা দুরাশায় পরিগণিত হবে। তাছাড়া অনেক
দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমি আপনাদের অনুরোধ করব এহেন অবস্থায় এ এটি যেন আপনারা
নিউজ না করেন। আমি আপনাধের অনুরোধ করছি মাত্র, আশা করি বিবেচনায় নিবেন।
আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন যে
আমরা এটি নিউজ করবনা। তাদের সুযোগ দিতে চাই, স্যার। আপনাকেও ধন্যবাদ। আনন্দে আমার
চোখ চিকচিক করে উঠল।
ততক্ষনে তাদের নিকটাত্মীয়রা চলে এসেছেন।
ছেলে-মেয়েদের তাদের হাতে বুঝিয়ে দিলাম। বললাম তারা একটা ভুল করেছে, তাদেরকে সুযোগ
দিয়েছি আমরা , আপনারাও সুযোগ দিন। ওদের ক্ষমা করে দিন। সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহ
দিন। সুদিন আসবেই।
ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে থাকালাম, সবাই কাঁদছে। সবাই
স্যার, স্যার করছে। এই প্রথম মনে হলো সাজা
না দিয়েও অনেক বড় সাজা দেয়া যায়। মোবাইল কোর্ট যদি হয় অপরাধ প্রতিরোধের জন্য তাহলে
নিশ্চই আমি ভুল করিনাই। সরল বিশ্বাসে আমি অনেকগুলো স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছি
যারা আগামীর বাংলাদেশকে এগিয়ে নিবে। একদিন তাদের অনেকেইই বড় চেয়ারে বসবে আর অসহায়
বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটাবে আমি সে দৃশ্য তাদের চোখের মধ্যে দেখে কোর্ট বন্ধ করি।
হাঁটছি আর মনে মনে বলছি হে আইন! আজ আমি বিচার না ইনসাফ করেছি ! ইনসাফ...
বি. দ্র. সঙ্গত কারণে আমি অসামীদের নাম দিতে চাইনাই। সময়টা
ছিল ২০১৬ সালের শেষের দিকের একটা সময়। আর ঘটনাস্থল নেত্রকোণা সদর।
লেখক: মোঃ শরীফ উদ্দিন, সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউতিভ ম্যাজিস্ট্রেট,
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নেত্রকোণা।
