ঝাল চিনি !

Client Logo
  • গল্প লিখেছেনঃ  তাহমিলুর রহমান
  • তারিখঃ 2017-03-13
  • ভিজিটঃ 1368
 
রমজানে বাংলাদেশে সকল পণ্যে অতিরিক্ত দাম নেয়া একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম জনাব মেজবাহ উদ্দিন প্রতিদিনই কোন না কোন মিটিং এ দাম কমানোর অনুরোধ করে চলেছেন। আলোচনা, তদারকি, ভৎসনা সব করেও কেন জানি কমছিলো না দামগুলো। চট্টগ্রাম কে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক হৃতপিন্ড বলা যেতে পারে। এখানে দাম বাড়লে পঞ্চগড়ে যে কোন কিছুর দাম কোথায় গিয়ে পৌছুবে তা সহজেই অনুমেয়। যাক সে কথা, মেজবাহ স্যার বললেন হার্ড লাইনে যাও। কঠোর ব্যবস্থা না নিলে দামে পরিবর্তন আনা যাবে না। শুরু হল বাজার মনিটরিং। একসাথে পাচটি টিম একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে রমজানের কয়েকদিন আগে থেকেই বাজারে বাজারে ঘোরা শুরু করে দিল। ছোলা, খেজুর, চিনি, মাংস, সবজি সহ সকল পণ্যের দামে লাগাম টেনে ধরতে হবে। মোটামুটি সবগুলোর দামই একটা সহনীয় পর্যায়ে আসলো, আসছিলো না শুধু চিনি! ৮ জুন, ২০১৬, সকাল ১০ টায় হঠাৎ ডিসি স্যার ডেকে পাঠালেন। বললেন চিনির বাজার টা দেখে আসো। গেলাম বাংলাদেশের বিখ্যাত বাজার খাতুনগঞ্জে, খবর দিলাম চট্টগ্রামের সকল সাংবাদিকদের। চিনির বাজার নিয়ে আমার একটা স্টাডি ছিলো আগে থেকেই। কোন কোন গ্রুপ বাংলাদেশে চিনির বাজার নিয়ন্ত্রন করে জানা ছিলো। এমন কি সে বছর কোন গ্রুপ কতটুকু চিনি চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি করেছে সে হিসেব ছিলো। খুজে পাচ্ছিলাম না, দামটা বাড়াচ্ছে কে। আমার হিসেবে প্রতি কেজি চিনির দামআমদানি-ট্রান্সপোর্টেশন-মেন্টেনেন্স-লাভ মিলে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা হবার কথা। সেখানে চিনির দাম খুচরা প্রায় ৭৫ টাকা। খোজ নিয়ে জানলাম, চট্টগ্রামের চিনির বাজার মীর আহমদ সওদাগরের দখলে। খাতুনগঞ্জের অলি গলি ভেদ করে জরাজীর্ন এক বিল্ডিং এর দোতালায় তাদের অফিস খুজে পেলাম। এখান থেকে পুরো চট্টগ্রামের চিনির বাজার নিয়ন্ত্রন হয়, বিশ্বাস হলো না। সকাল সকাল যাওয়াতে তখনো সকল স্টাফ আসেনি। একজনে কে পেলাম, বললেন মালিক নেই আর নিজের পরিচয় দিলেন একাউন্টস অফিসার। আমি বললাম, আমি মালিক না আপনাকেই খুজছি! আমাকে চিনি কত করে কেনা আছে আর কোন কোন পার্টির কাছে কত করে বিক্রয় করছেন দেখান। বলার সাথে সাথেই তার চেহারাটা পালটে গেলো। বলল এসব হিসেবের হার্ড কোন কপি নেই, যা আছে সবই কম্পিউটারে, আর পাসওয়ার্ড মালিকের কাছে। কথা গুলো যখন বলছে, তার চোখে তাকালাম। দেখলাম কনফিডেন্স কম। বললাম ঠিক আছে, আমরা নিজেরাই আপনার ফাইল পত্রগুলো ঘেটে দেখি পাই কি না! শুরু হলো সার্চ, কিছুক্ষণের মাঝেই পেয়ে গেলাম যা খুজছিলাম! দুটি ফাইল, একটিতে দেখা গেলো অই তারিখ থেকে আগামী এক মাস পর্যন্ত কোন প্রতিষ্ঠিত এক কোম্পানি থেকে সকল চিনি অগ্রিম কিনে রেখেছে এই প্রতিষ্ঠান। ক্রয়মূল্য হিসেব করে পাওয়া গেলো ৪৬ টাকা। আরেকটি ফাইলে পেওয়া গেলো, চট্টগ্রামসহ এ বিভাগের বিভিন্ন পাইকারের কাছে তাদের বিক্রয় করা ও অর্ডার নেয়া চিনির মূল্য তালিকা। বিক্রয়মূল্য ৫৮.৫৭ টাকা!! মানে পাইকারি বাজারে যাওয়ার আগেই প্রতি কেজিতে ১২.৫৭ টাকা করে লাভ! পাওয়া গেলো! সাথে সাথে জানিয়ে দিলাম ডিসি স্যারকে। তিনি বললেন অফিসে নিয়ে আসো এদের। এর মাঝে এসেছিলো এ কম্পানির ম্যানেজার (পরে জেনেছি তিনি নিজেও এ প্রতিষ্ঠানে বড় শেয়ার হোল্ডার!)। তাকে সহ নিয়ে যাব। এমন সময় আমার একজন এসে আমাকে জানালো নিচে অনেক শ্রমিক জড় হয়েছে, এরা ঝামেলা করতে পারে। এখন নতুন চ্যালেঞ্জ, কিভাবে বেরিয়ে যাব এখান থেকে। আগেই প্লান করে আমি আমাদের ও র‍্যাবের গাড়িগুলো দূরে রেখে হেটে এসেছিলাম এখানে। আমার ড্রাইভার কে বলে দিলাম এখান থেকে চলে গিয়ে টেরি বাজারের সামনে বড় রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাও। এখানে বলে রাখা ভালো, গুগল স্ট্রিটে আগেই দেখে রেখেছিলাম এ বাজার। খুবই ঘিঞ্জি, একটা গাড়ি আসলে আরেকটা যেতে পারে না। ভাবলাম আসামী নিয়ে নামার সময় গাড়িতে হামলা করা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। তাই এ অগ্রিম এ পদক্ষেপ। র‍্যাবের সদস্যদের ব্রিফ করে দিলাম, কিভাবে আমরা বের হতে চাই। আমার সাথে তখ চৌত্রিশ ব্যাচের দুই অফিসার ছিলো, সামাদ আর হাসান। র‍্যাবের সদস্য ছিলো মাত্র ১২ জন। একজন অফিস সহায়ক ও একজন অফিস সহায়কও ছিলেন। আর ছিলেন প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ার প্রায় ২০ জন সাংবাদিক। যখন বের হলাম, দেখি প্রায় হাজার খানেক শ্রমিক সিড়ির নিচে আমাদের ঘিরে রেখেছে। সাংবাদিকদের ক্যামেরা গুলো সব চলছে! আমরা আসামী সহ নামতেই শ্রমিকের হইহুল্লোর করে উঠলো। দূরে কয়েকজনের হাতে দেখলাম বড় বড় লাঠি আর জি আই পাইপ। একজন টিভি রিপোর্টার বললেন, পরিবেশ খুব সুবিধার না, এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। আপনার দুর্বলতা পেলেই এরা আক্রমনাত্নক হয়ে উঠবে। আমি সিড়ি দিয়ে নামা শুরু করলাম শ্রমিকদের উদ্দ্যেশ্যে বললাম, ৭৫ টাকা করে চিনি আপনারদেরো কিনে খেতে হয়। আপনাদের মত সাধারন মানুষের প্রতি এই বিচার হতে দেয়া যায় না। বলেই হাটা শুরু করলাম। প্রায় ৫/৭ মিনিট হেটে বিপজ্জনক এলাকা পার হয়ে আসলাম। পরবর্তীতে দন্ডবিধি ১৮৯ এ, সরকারী কাজে হুমকি প্রদানের অপরাধে এ কম্পানির মালিককে বিশ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। ঠিক পরের দিন থেকে চট্টগ্রামে চিনির দাম পাইকারি ৫০ ও খুচরা ৫৫ টাকায় নেমে এসেছিলো। আমার ছোট কর্মজীবনে এ ঘটনা আমাকে খুবই তৃপ্তি দেয়। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জনগনকে এ সেবা দিতে পারা আমার জন্য খুবই উৎসাহব্যঞ্জক ছিলো। শুধু চিনিই না সে বছর চট্টগ্রামে কোন পণ্যেরই মূল্য আমরা বৃদ্ধি হতে দেইনি। সেদিনই বানিজ্যমন্ত্রী ঢাকায় এক সভার বলেছিলেন, বাজার জিম্মি করলে পরিনতি হবে মীর গ্রুপের মত। এ বক্তব্য আমার আত্নবিশ্বাস বাড়িয়েছে। মোবাইল কোর্ট চলুক, জনসেবা নিশ্চিত হোক।

 প্রিন্ট